খুলিও কর্তাজার আর্জেন্তিনার লেখক। হিসেবমত তাঁকে আমার তুলনামূলক সাহিত্যের লাতিন আমেরিকা বিশেষ পত্রে পড়ার কথা ছিল কিন্তু পড়েছিলাম আদতে ফিল্ম স্টাডিজ-এর ক্লাসে। আন্তোনিওনির ‘ব্লো-আপ’ চলচ্চিত্রটি তাঁর একই নামের একটি ছোটগল্পে আধারিত ছিল বলে। তখন ভারি অদ্ভূত লেগেছিল যদিও। প্রায় বছর পাঁচেক পর ‘ব্লো-আপ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ নামে একটি গল্প সংকলন হাতে এসে পড়ে, তখন নতুন করে আবিষ্কার করি কর্তাজারকে। কোনও কিছু পড়তে ভালো লাগলেই আমার অনুবাদ করতে ইচ্ছে করে। কর্তাজারের গল্পে আরও একটা জিনিস ইচ্ছে করতে লাগল। তাঁর শহরচেতনা এবং অদ্ভূত রসের ব্যবহারে একটা বিশেষ ঔপনিবেশিক ধাঁচ আছে যেটার সঙ্গে বারবার আমার নিজের কলকাতাকে পড়ার দৃষ্টিভঙ্গিটা মিলে যাচ্ছিল। আমার অনুবাদে আস্তে আস্তে আর্জেন্তিনার স্থান-কাল-বস্তু ইত্যাদি নির্ণায়কগুলো বদলে যেতে লাগল কলকাতার নির্ণায়কে। অনুবাদ আর রইল না, অনুকৃতি হয়ে গেল। বাক্যগঠন ও রচনাপরম্পরায় যথাসম্ভব মূলানুগ থেকেছি, খালি বিশেষ্যগুলো বদলে বদলে গেছে।
বাড়িটা আমাদের বড় ভালোলাগার ছিল। সাবেকি আর খোলামেলা বলে তো বটেই (বিশেষ করে এ যুগে যখন পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙেচুরে চড়া দামে কাঠ-পাথর মালমশলা নিলাম হয়ে যাওয়াই দস্তুর), তাছাড়া আমার ঠাকুর্দার বাবা থেকে শুরু করে ঠাকুর্দা-ঠাকুমা, আমাদের বাবা-মা আর আমাদের গোটা ছোটবেলাটার সমস্ত স্মৃতিই যে ধরা আছে এ বাড়িতে।
আমি আর সরসী আসলে বাড়িটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। সেটা বেশ অদ্ভূত, কারণ ও বাড়িতে অন্তত আট জন ফেলে ছড়িয়ে থাকতে পারবে। সকাল সাতটায় উঠে পড়তাম, হাত-মুখ ধুয়ে শুরু হত ঝাড়পোঁছ। এগারোটা নাগাদ আর যে যে ঘর বাকি রইল সরসীর উপর ছেড়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়তাম। ঠিক ১২টায় দুপুরের খাওয়া; তারপর চারটি এঁটো বাসন, আর ব্যাস, ছুটি। দুপুরের খাবার খেতে খেতে মস্ত ফাঁকা নিঃঝুম বাড়িটার সঙ্গে বেশ একটা আলাপচারিতা চলত, ভারি ভালো লাগত। ঘরদোরটুকু শুধু সাফসুতরো থাকুক, আমাদের তাই যথেষ্ট ছিল। মাঝে মাঝে দুজনেরই মনে হত, বোধহয় এই জন্যই কারও আর বিয়েটা করা হয়ে উঠল না। সরসী পর পর দুটো সম্বন্ধ তানা নানা করে কাটিয়ে দিল। আর আমি তো বিয়ে-থার কথা পাড়ার আগেই নির্মলা চোখের সামনে দিয়ে পরলোক পাড়ি দিল। এ বাড়িতে আমাদের তিন পুরুষের বংশপরম্পরা ভাই আর বোনের শান্ত-সহজ দাম্পত্যে এসে থেমে যাবে, এই অনুচ্চারিত নিয়তিকে গ্রহণ করে নিতে নিতেই চল্লিশের কোঠায় পা রেখে ফেলেছিলাম। একদিন এখানেই মরে যাব, তার পর কোন লতায় পাতায় আত্মীয়দের ভাগে পড়বে বাড়িটা, আর তারা বিন্দুমাত্র দেরি না করে বাড়ি ভেঙে, ইঁট-কাঠ বেচে, জমির পয়সায় ফুলেফেঁপে লাল হবে। তার চেয়েও ভালো, বেশি দেরি হওয়ার আগে আমরা নিজেরাই হয়তো ভাঙাভাঙির পাট চুকিয়ে দেব।
সরসী কারও সাতেপাঁচে থাকত না। সকালের কাজকর্ম শেষে হয়ে গেলে নিজের ঘরে জানলার ধাপিটায় হেলান দিয়ে বসে উল বুনত। সারাক্ষণ এত বুনত কেন জানি না; আমার বরাবরই মনে হয় মেয়েরা উল বুনতে তখনই শুরু করে যখন তারা এটা বুঝে ফেলে যে কিচ্ছু না করার এর চেয়ে ভাল উপায় আর নেই। সরসীর ব্যাপারটা তেমন ছিল না। ও সবসময় কাজের জিনিস বুনত। আমার জন্য সোয়েটার, মোজা, নিজের জন্য শাল, চেয়ারে পাতার আসন, টুকিটাকি রাখার দেওয়ালে ঝোলানো খাপ। হয়তো একটা গরম কোট বুনতে শুরু করল, কিছুক্ষণ পর দেখি পুরোটা খুলে ফেলেছে, কোথাও একটা কিছু মনমত হয়নি। সরসীর পায়ের কাছে ঢেউ খেলিয়ে, জড়িয়ে মড়িয়ে পড়ে থাকত উলের রাশি, কাঁটার বুনোটে তৈরি হওয়া নতুন অবয়ব ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টায়। বেশ লাগত দেখতে। মাসে একবার করে নিউ মার্কেট যাওয়া হত উল কিনতে; সরসীর আমার পছন্দে সম্পূর্ণ আস্থা ছিল, যাই রঙ আনতাম খুশি হয়ে নিয়ে নিত, একবারের জন্য ফেরত দিয়ে কি বদলে আনতে হয়নি। এই ছুতোয় কলেজ স্ট্রিটের দিকটাও ঢুঁ মেরে আসতাম একবার, নতুন বিদেশি সাহিত্যের ব্যর্থ খোঁজে। সেই আশির দশকের পর থেকে মনোমত আর কিছুই পাইনি।
কিন্তু আমি আসলে বাড়িটার কথা বলতে চাই, বাড়ি আর সরসীর কথা, আমি নিজে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নই। ভাবি, বোনার ঝোঁকটা না থাকলে সরসী কী করত। বই ফিরে পড়া যায়, কিন্তু একটা সোয়েটার তো একবার শেষ হয়ে গেলে আর খুলে বোনা যায় না, সে ভারি লজ্জার ব্যাপার নাকি। টানা দেরাজের একেবারে শেষ তাকটায় এক দিন দেখেছিলাম, গুচ্ছ ন্যাপথলিন বল সহযোগে প্রচুর প্রচুর শাল, সাদা, সবুজ, আকাশি, বেগুনি। তীব্র কর্পূর গন্ধ মেখে থরে থরে সাজানো আছে – দেখে মনে হচ্ছিল যেন দোকানে রাখা; আমার সাহস হয়নি জিজ্ঞেস করব যে এত এত শাল নিয়ে কী করবে বলে সে ভাবছে। আমাদের তো খেটে রোজগার করার দরকার পড়েনি কখনও। দেশ থেকে মুন্সীবাবু যে মাসোহারা পাঠান তাই উদ্বৃত্ত হয়। সরসী বুনত বোনার নেশায়, তেমনি ছিল তার হাত। আর ওকে দেখতে দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা অজান্তে কেটে যেত আমার, নদীর গভীরে রুপোলি মাছের মত সহজ চলনে দু’হাতের কাঁটা চলছে, মেঝেয় রাখা সাজি থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে একটা কি দু’টো পশমি বল। ভারি মনোরম।
বাড়িটার নকশা স্মৃতিতে গাঁথা আছে। বাড়ির একেবারে পিছনের দিকটা, মানে কালীবাড়ির দিকে মুখ করে থাকা অংশটায় একটা বড় খাওয়ার ঘর, সাবেক কার্পেটে মোড়া বিরাট বৈঠকখানা, লাইব্রেরি আর তিনটে বড় বড় শোয়ার ঘর ছিল। আগবাড়ি আর পিছনবাড়ির মধ্যে যোগসূত্র একটা সরু করিডর, তার শেষে মস্ত শাল কাঠের দরজা। দরজার এদিকে কলঘর, রসুঁই, আমাদের দু’জনের দু’টো শোয়ার ঘর আর বৈঠকখানা। বাড়িতে ঢোকার মুখে সদর দালান, তার দেওয়ালে ছবি আঁকা চিনেমাটির শৌখিন টালি। দালানের শেষে কালো লোহার জাল দেওয়া সদর দরজা একেবারে বৈঠকখানা ঘরে খুলত। বাড়ি ঢুকতে হলে দালানটা পেরিয়ে এসে গেট খুলে বৈঠকখানা ঘরে ঢুকতে হবে; ডান ও বাঁয়ে আমাদের দু’জনের দু’টি ঘরের দরজা, আর ঠিক উলটো দিকে পিছনবাড়ি যাওয়ার করিডরটা; সরু পথ উজিয়ে গিয়ে করিডরের শেষ প্রান্তে শাল কাঠের দরজাটা খুললে বাড়ির অন্য দিকটায় পৌঁছে যাওয়া যাবে, আর নয়তো দরজার ঠিক আগে বাঁ দিকে ঘুরে গেলে আরও সরু একটা গলিপথ পৌঁছে দেবে রঁসুই আর কলঘরের দিকটায়। শালের দরজাটা খোলা থাকলে বোঝা যেত বাড়িটা আসলে বিরাট; আবার দরজা বন্ধ করে দিলেই যেন বা ফ্ল্যাটবাড়ি, যেমন সব আজকাল বানায়, ঠিকমত নড়াচড়া করারই জায়গা থাকে না। সরসী আর আমি সামনের দিকটাতেই থাকতাম সাধারণত, ঘর পরিষ্কারের সময়টা ছাড়া দরজার ওপাশে বড় একটা যাওয়া হত না। আসবাবে যে কত ধুলো জমতে পারে সে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এই দিকটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বটে, কিন্তু সেটা বাসিন্দাদেরই কৃতিত্ব। এ শহরের বাতাসে ধুলোবালি বড্ড বেশি, একটু কী হাওয়া দিল, অমনি শ্বেতপাথরের টেবিল আর চৌখুপি প্যাটার্ন আঁকা কার্পেটের উপর ফের জাঁকিয়ে বসবে মিহি আস্তর। ঝুলঝাড়ু দিয়ে সে ধুলো ছাড়ানো এক দক্ষযজ্ঞ; চিকন চিকন ধুলোর কণা শূন্যে ভেসে উঠবে, আবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নেমে এসে থিতু হবে কাচের দেরাজ আর পাথরের পরীর মাথায়।
ব্যাপারটা এত সহজে আর নিশ্চুপে ঘটে গেছিল বলেই বোধহয় আমার সারাজীবন স্পষ্ট মনে থাকবে। সরসী নিজের ঘরে উল বুনছিল, রাত তখন আটটা, হঠাৎই মনে হল একটা চা হলে মন্দ হয় না। করিডর দিয়ে দরজা পর্যন্ত গেছি যেটা আধখোলা অবস্থায় আছে, বাঁয়ে ঘুরে রান্নাঘরে ঢুকতে যাব এমন সময় লাইব্রেরি কি খাবার ঘরের দিক থেকে একটা শব্দ এল। খুব চাপা, অস্পষ্ট, যেন কার্পেটের উপর চেয়ার পড়ে গেল একটা, বা নীচু গলায় কেউ কথা বলছে। প্রায় একই সময়ে, বা হয়তো এক সেকেন্ড পরে, শব্দটা এল ঐ দু’টো ঘর থেকে দরজার দিকে যে করিডরটা আসছে তার মাথা থেকে। এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্ধ করে পুরো ওজন দিয়ে চেপে দাঁড়ালাম; কী ভাগ্যি চাবিটা আমাদের দিকেই লাগানো ছিল; আর মস্ত হুড়কোটাও তুলে দিলাম সেই সঙ্গে, সাবধানের মার নেই।
তারপর রান্নাঘরে গেলাম, কেটলিতে জল চাপালাম, রেকাবে করে চা নিয়ে ফেরত যাওয়ার পর সরসীকে বললাম:
“করিডরের দরজাটা আটকে দিতে হল। ওরা পিছনের দিকটা দখল করে নিয়েছে।”
কোলের উপর উল-কাঁটা খসে পড়ল, ক্লান্ত, বিষণ্ণ চোখজোড়া তুলে আমার দিকে তাকালো সে।
“ঠিক বলছ?”
আমি ঘাড় নাড়লাম।
উল-কাঁটা তুলে নিতে নিতে সে বলল, “তাহলে আমাদের এবার থেকে এই দিকটাতেই থাকতে হবে।”
আমি আস্তে ধীরে চায়ে চুমুক দিতে শুরু করলাম, তার কিন্তু ফের কাজ শুরু করতে আরও কিছুটা সময় লেগেছিল। মনে আছে, একটা ধূসর রঙের মাফলার বুনছিল সে। মাফলারটা আমার প্রিয় ছিল।
প্রথম ক’দিন খুব কষ্ট হয়েছিল, কারণ দখল হওয়া দিকটাতে আমরা দু’জনেই অনেক কিছু ফেলে এসেছিলাম। যেমন আমার গোটা রবীন্দ্র রচনাবলী লাইব্রেরি ঘরে পড়ে থেকে গিয়েছিল। সরসী ফেলে এসেছিল দিস্তা দিস্তা রঙবেরঙের চিঠি লেখার কাগজ, আর শীতকালে পরার চটিজোড়া। হাতির দাঁতে বাঁধানো পাইপটার জন্য আমার মন কেমন করত, আর সরসী বোধহয় ঐ আদ্যিকালের কাশ্মিরী কাঠের হোমিওপ্যাথি বাক্সটার দুঃখ কখনওই ভুলতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই (তবে ঐ প্রথম ক’দিনেই) কোনও একটা দেরাজ কি টেবিলের টানা বন্ধ করে বিষণ্ণ মুখে এ ওর দিকে তাকাতাম আমরা।
“নাঃ, নেই।”
মানে বাড়ির অন্য দিকে হারিয়ে যাওয়া হরেক জিনিসের তালিকায় আরও একটা যোগ হল।
তবে সুবিধেও ছিল। ঝাড়পোঁছের কাজ এতটাই কমে গেছিল যে যত দেরি করেই উঠি না কেন, এমনকী সাড়ে নটা বেজে গেলেও, এগারোটার মধ্যে সব কাজ গুটিয়ে হাত তুলে বসে পড়া যেত। দুপুরের রান্নার সময় সরসী আমার সঙ্গে রান্নাঘরে আসতে শুরু করল। আমরা ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্তে এলাম: আমি যতক্ষণ দুপুরের খাবার বানাবো, সরসী সন্ধ্যের জলখাবারের জন্য টুকিটাকি কিছু একটা বানিয়ে রাখবে। এই ব্যবস্থাটা আমাদের বেশ মনোমত হল, কারণ সন্ধ্যেবেলা নিজের নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আবার রান্নাবান্নার জোগাড় করা সত্যিই বড্ড বিরক্তিকর লাগত। এখন সরসীর ঘরের জালের দেরাজ আর ছোট ফোল্ডিং টেবিলেই কাজ সারা হয়ে যাচ্ছিল।
উল বোনায় আরও সময় দিতে পারছে বলে সরসীও খুশি ছিল। আমার বইগুলো না থাকায় একটু অসুবিধা হচ্ছিল বটে, কিন্তু সরসীকে বিরক্ত করাও তো কাজের কথা নয়, তাই বাবার স্ট্যাম্পের খাতাগুলো নতুন করে সাজাতে বসলাম; এতে করে কিছুটা সময় কাটানো যাচ্ছিল। নিজেদের মনোরঞ্জন আমরা নিজেরাই যথেষ্ট করে নিতে পারতাম, দু’জনেরই নিজের নিজের শখ ছিল। সরসীর ঘরেই সাধারণত একসঙ্গে বসা হত, দু’টো ঘরের মধ্যে ওটাই বেশি আরামদায়ক। মাঝেসাঝে সরসী হয়তো বা বলে উঠল:
“এই দ্যাখো এই নকশাটা বার করলুম, কেমন লবঙ্গের মত দেখাচ্ছে না?”
তার কিছুক্ষণ পর আমার পালা, একটা কি দু’টো কাগজের টুকরো ওর দিকে ঠেলে দেওয়া যাতে প্যারিস কী পাপুয়া-নিউগিনি থেকে আসা মহার্ঘ স্ট্যাম্পটি সে ভালো করে দেখতে পায়। ভালোই ছিলাম আমরা, আর ধীরে ধীরে ভাবনাচিন্তা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভাবনাচিন্তা না করেও দিব্যি বেঁচে থাকা যায়।
(সরসী ঘুমের মধ্যে কথা বলে উঠলেই আমার ঘুম ভেঙে যেত, আর আসত না। যেন বা কোনও মর্মরমূর্তি থেকে ভেসে আসা স্বর, বা তোতার বলা কথা; আমি কোনও দিনই ঐ আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি, সে স্বর ওর গলা থেকে আসত না, আসত স্বপ্ন থেকে। সরসী আবার বলত, আমি নাকি ঘুমের মধ্যে সারা বিছানা জুড়ে আছড়ে বেড়াই, গা থেকে আলোয়ান খুলে চলে আসে। আমাদের দু’জনের মধ্যে একটা গোটা বৈঠকখানা ছিল, কিন্তু রাতের বেলা বাড়িটায় সব শব্দ স্পষ্ট শোনা যেত। শুয়ে শুয়ে আমরা একে অন্যের কাশির শব্দ, শ্বাসের শব্দ শুনতাম। যে রাতগুলোয় কেউই ঘুমোতে পারতাম না, যা কিনা প্রায়ই হত, একে অন্যের আলোর সুইচের দিকে হাত বাড়ানো পর্যন্ত টের পেতাম।
আমাদের নৈশ ফিসফিসানি ছাড়া বাড়িতে আর সবকিছু নিঃস্তব্ধ ছিল। দিনের বেলায় বাড়ি ভরে থাকত নানা সাংসারিক আওয়াজে, উলের কাঁটার ঠুন ঠান, স্ট্যাম্প অ্যালবামের পাতা ওল্টানোর খস খস। শালকাঠের দরজাটা ছিল বিশাল, সেটা বোধহয় আগেই বলেছি। দখল হওয়া অংশের পিঠোপিঠি যে দু’টো ঘর, সেই রঁসুই আর কলঘরে আমরা সব সময়ে জোরে জোরে কথা বলতাম, নয়তো সরসী গান গাইত একের পর এক। রান্নাঘরে এমনিতেই অনেক আওয়াজ হয়, থালা-বাসনের কলরোলে অন্য কোনও শব্দের অনুপ্রবেশের জায়গা সাধারণত থাকে না। এই ঘরগুলোয় নিজেদের কিছুতেই নীরব হয়ে যেতে দিতাম না আমরা, কিন্তু নিজেদের ঘরে কী বৈঠকখানায় যখন ফিরে যেতাম, বাড়িটা নিঝুম হয়ে আসত, আলো-আঁধারি, আর একে অন্যকে বিরক্ত করব না বলে আমরা প্রায় পা টিপে টিপে হাঁটাচলা করতাম। আমার ধারণা, এই জন্যই সরসী ঘুমের মধ্যে কথা বলতে শুরু করলেই আমার ঘুমটা ভেঙে যেত এবং আর আসত না।)
এ বারের ঘটনা পরম্পরা একেবারেই এক রকম, খালি পরিণামটা ছাড়া। সে রাতে তেষ্টা পেয়েছিল খুব, শুতে যাওয়ার আগে আমি সরসীকে বললাম রান্নাঘর থেকে জল নিতে যাচ্ছি। ঘরের চৌকাঠে পৌঁছতেই শুনতে পেলাম (সে উল বুনছিল মন দিয়ে), রান্নাঘর থেকে শব্দটা আসছে; রান্নাঘর নয়তো কলঘর, ওখানে করিডরটা এমন ভাবে বেঁকেছে যে আওয়াজ আবছা হয়ে যায়। আমি যে হঠাৎ করে থেমে গেছি সেটা সরসী লক্ষ্য করেছিল, একটিও কথা না বলে উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমরা কান পেতে শুনতে লাগলাম, ক্রমেই আরও নিশ্চিত হয়ে যে আওয়াজগুলো শাল কাঠের দরজার এদিকটা থেকেই আসছে, রান্নাঘর নয়তো কলঘর থেকে, কিংবা একেবারে বৈঠকখানাতেই, করিডরের বাঁকটা ঘুরেই, প্রায় আমাদের ঘাড়ের উপর।
একে অন্যের দিকে তাকানোর সময়টুকুও নষ্ট করিনি আমরা। সরসীর হাত ধরে একরকম হিড়হিড় করে টানতে টানতে ছুটে লোহার সদর দরজায় এসে পৌঁছলাম, একবারও পিছু না ফিরে। শব্দ তখনও আসছিল, চাপা কিন্তু আরও স্পষ্ট, ঠিক আমাদের পিছনে। ছিটকিনিটা টেনে দিয়ে দালানে এসে দাঁড়ালাম আমরা। আর কোনও আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না।
“আমাদের দিকটাও দখল করে নিয়েছে ওরা”, সরসী বলে উঠল। তার হাতে ধরা উল-কাঁটা অবিন্যস্ত, উলের রাশি দরজার দিকে গড়িয়ে গিয়ে তলার ফাঁক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। পশমের গোলাগুলো ও’দিকে রয়ে গেছে বুঝতে পেরেই হাত থেকে কাঁটা ফেলে দিল সে, আর ফিরেও তাকালো না।
হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু কি নিয়ে আসার সময় পেয়েছিলে?”
“নাঃ, কিচ্ছু না।”
গায়ের কাপড়টুকুই শুধু ছিল। শোয়ার ঘরের আলমারিতে পনেরো হাজার টাকা রাখা আছে, মনে পড়ল। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
হাতঘড়িটা পরা ছিল, দেখলাম রাত ১১টা বাজে। সরসীর কাঁধে হাত রাখলাম আমি (সে বোধহয় কাঁদছিল), আর সেইভাবেই আমরা রাস্তায় নেমে এলাম। একেবারে ছেড়ে যাওয়ার সময়টা বড্ড কষ্ট হচ্ছিল; বাগানের গেট ভালো করে তালা দিয়ে চাবিটা নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। বলা তো যায় না, কোনও ছিঁচকে হতভাগা যদি চুরি করা মনস্থ করে বসে; এই এত রাত, তার উপর বাড়িটাও তো বেদখল হয়ে আছে।
(সঙ্গের ছবিটি ইস্তানবুলের চিত্রগ্রাহক অ্যালপার ইয়েসিলতাস-এর তোলা। ১২ বছর ধরে প্রতিবেশী বাড়ির এই জানলাটির ছবি তুলে গেছেন তিনি। ১২ বছর পরে বাড়ি মালিকেরা সেটি ভেঙে নতুন বাড়ি তুলে দেয়। পুরনো বাড়িটি এখন শুধুই অ্যালপারের ছবিতে ধরা আছে।)